ভিক্টোরিয়া শহীদ মিনার

কোন ইতিহাসের পাতায় চাইলে

আমায় খুজে পাবে না।

ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়ে

কুষ্ঠ রোগীর আস্তাকুঁড়ে চাইলেও

আমার নেই যে ঠিকানা

পথের ধারে কাঁচের জারে

সোনালী মাছ খেলা করে

বেঁচে থাকে জীবন্ত কঙ্কাল।

 

আমার পূণ্য, আমার পাপ,

আমারই নাম কোলকাতা!

 

এসো আমার ঘরে একবার

তুমি এসো আমার ঘরে একবার

পারো যদি দেখে যেও

বেঁচে থাকা কারে বলে

এসো আমার শহরে একবার…

 

অঞ্জন দত্তের গানের এই লাইন গুলো সত্যিই কলকাতার আসলরূপ তুলে ধরে। ইন্টারনেটের যুগে ভিক্টোরিয়া, রবীন্দ্রসদন, চিড়িয়াখানা পর্যন্তই এখন কলকাতার বাঙালির দৌড়। কিন্তু রঙ চড়ানো , অতিরঞ্জিত কলকাতার মধ্যেই আরও একটি অচেনা কলকাতা আছে । চলুন আজ সেই কলকাতাটা একবার ঘুরে দেখে আসি। 

 

অচেনা কলকাতার সফর শুরু করার আগে মাথা আর পেট দুটোই ঠান্ডা থাকার খুব প্রয়োজন । তাহলে প্রথমেই চলে যাই আজকের প্রথম ডেস্টিনেশন-

 

১) কলেজ-স্কোয়ার প্যারামাউন্টের দোকানে

পুরনো কলকাতার কিছু বিখ্যাত দোকানের মধ্যে এটি একটি। প্যারামাউন্টের বিখ্যাত ডাবের সরবত খেতে খেতে সামনের ঝোলানো বোর্ডে আপনার চোখে পরলে দেখবেন কে না কে এসেছে এই দোকানের সরবত খেতে। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের থেকে উত্তম বাবু সবাই  এই দোকানের ডাবের সরবতের মজা নিয়েছেন। শুধু ডাব নয় ১৯১৮ সাল থেকে নানান ধরনের সরবত এখানে বিক্রি হয় । মাথা ,পেট ঠান্ডা হলে এবার চট করে চলে যাই সেই বাঙালির বাড়িতে যিনি শিকাগোতে বক্তৃতা দিয়ে বাঙালি তথা ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন। 

 

২) স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি 

সরবত খেয়ে এবার পৌছে গেলাম গৌর মোহন মুখার্জি স্ট্রিটে । অর্থাৎ স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দের পৈত্রিক বাড়িতে । বাড়িটা ঘুরুন চারিদিক দেখুন আর ইতিহাসের বইয়ে পড়া সেই সমস্ত ঘটনা গুলিকে আরেক বার মনে করে নিন। 

 

৩)স্বামীজির বাড়ি থেকে বেরিয়েই সামনের ফুটে দেখতে পাবেন চাচা’স হোটেল । এই হোটেলটা কিন্তু আগে স্বামীজির বাড়ির ফুটেই ছিলো পরে এই ধরুন ২০০৭এর দিকে তা সামনের ফুটে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ২০২২ সালে এই হোটেল চালানোর লোক না থাকায় এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই দোকানের ফিশ ফ্রাই, ফাউল কাটলেট এবং শিক কাবাব একটি বিশাল জনপ্রিয় পদ ছিল। মাটন শিক কাবাব প্রথম চাচাই শুরু করেছিলেন। তাদের অসংখ্য পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি ফাউল কাটলেট খুব পছন্দ করতেন , সুভাষ চন্দ্র বসু, যার প্রিয় শিক কাবাব এবং বিধান চন্দ্র রায়, যিনি চিকেন ক্লিয়ার স্যুপ খেতে ভালোবাসতেন।   

৪)স্বামীজির বাড়ির ফুট ধরে একটু সামনে এগোলেই দেখতে পাবে ভারত বিখ্যাত গিরিশ ও নকুরের মিষ্টির দোকান । 

৫)আর স্বামীজির বাড়ির ফুট ধরে পিছন দিকে গেলে পাবেন বিখ্যাত ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানের গায়ক মান্না দে’র বাড়ি

৬) অ্যাথেনিয়াম ইনস্টিটিউট

এক সময় এই বাড়িতেই থাকতেন ভারতের সেরা পরিচালক দের মধ্যে অন্যতম। ভুতেররাজা, মহারাজা, সিনেমার রাজা সত্যজিৎ রায় ।

 

৭) ব্যায়াম বীর বিষ্ণু ঘোষের আখড়ায়  

অ্যাথেনিয়াম ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে সামনে গিয়েই বাঁদিকে পড়বে ব্যামাচার্য বিষ্ণু ঘোষের আখড়া। যারা বলে বাঙালির গায়ে শক্তি হয় না, তারা পারলে একবার জায়গাটা দেখে যাবেন। সাআ বিশ্ব যখন জানতো ও না ব্যায়াম কাকে বলে তখন থেকে বাঙালি শরীর চর্চা করছে ।  তবে অ্যাথেনিয়াম ইনস্টিটিউট আর ব্যায়াম বীর বিষ্ণু ঘোষের আখড়াটা কিন্তু অবস্থিত গড়পাড়ে । নাম শুনে কিছু মনে পড়ল ? হ্যাঁ , সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার লাল মোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর বাড়ি ও কিন্তু এখানেই। ফিক্সানাল হলেও মানুষটা কিন্তু প্রতিটা বাঙালির অত্যন্ত প্রিয়। 

 

৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি এবং রবীন্দ্রভারতী 

 

  

পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,

আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।

 রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল

পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,

ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে

দিগঙ্গনার নৃত্য,

   হঠাৎ-আলোর ঝল্‌কানি লেগে

     ঝলমল করে চিত্ত। 

মাত্র ৩ মনিটের হাঁটা পথের ব্যাবধানে এই দুই স্থান । মনেকরে কিন্তু দেখে আসবেন আর পারলে উপরে দেওয়া কবিতাটাও জোড়ে জোড়ে আওড়ে নেবেন। কেউ কিচ্ছু বলবে না। 

 

৯) নাট্য ব্যাক্তিত্ব গিরিশ ঘোষের বাড়ি

দীনবন্ধু মিত্রের পরবর্তী কালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১১) বাংলা নাট্য জগতকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করেছেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ নাট্যকার ও প্রয়োগশিল্পী। তাঁর প্রচেষ্টাতেই বাঙালী দর্শক সর্বপ্রথম প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে নাটক দেখার সুযোগ পেয়েছিল। আর এই দাপুটে লোকটার বাড়ির ও কিন্তু অন্য এক ইতিহাস আছে এই বাড়িটা দেখবেন রাস্তার ঠিক মাঝখানে রয়েছে । হ্যাঁ তাকে সম্মান দিতে কলকাতা পৌরসংস্থা রাস্তা পাল্টেছে কিন্তু বাড়ি ভাঙে নি । 

 

১০) গঙ্গার ঘাট 

এর পর আহিরিটোলা , কলুটোলা, সব পেরতে পেরতে মন শান্ত করতে চলে আসবেন গঙ্গার পাড়ে । শহরের ভিড়ের বাইরে শান্ত পরিবেশে বেশ কিছুক্ষন সব ভুলে গঙ্গার স্রোতে হারিয়ে যাবেন। 

 

তাহলে আজকে শেষ হল আসল কলকাতার দর্শন। পারলে ঘুরে আসুন সঙ্গী থাকলে হাতে হাত ধরে ঘুরুন , আর না থাকলে নিজের ব্যাগ ধরে। কিন্তু ঘুরে আপনাকে আস্তেই হবে।    

 

এসো আমার ঘরে একবার

তুমি এসো আমার ঘরে একবার

পারো যদি দেখে যেও

বেঁচে থাকা কারে বলে

এসো আমার শহরে একবার…

 

 

 

 

 

 

 

Exit mobile version